আমরা জানব ডায়াবেটিসের ইতিহাস, কারন, ধরন, লক্ষন, সমস্যা, প্রতিকার, ইনসুলিনের ইতিহাসসহ ডায়াবেটিসের আপাদমস্তক
ডায়াবেটিস কি
আমরা সবাই কম বেশি কিছু অতি পরিচিত রোগের নাম জানি, তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। হতে পারে আমাদের অনেকের পরিবারের সদস্যও এ রোগে আক্রান্ত। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন (The American Diabetes Association) বলছে, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যা কখনো নিরাময় হয় না, কিন্তু সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
যখন অগ্নাশয় ইনসুলিন উৎপন্ন করতে পারে না বা উৎপাদিত ইনসুলিন যখন শরীর ব্যবহার করতে পারে না তখন রক্তে শর্করা বা চিনি ভারসাম্য থাকে না। এর ফলে যে রোগটির সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় মধুমেহ, বহুমূত্র রোগ বা ডায়াবেটিস মেলিটাস। মূলত ইনসুলিনের অভাবে এই রোগ হয়।
ইউকে-তে প্রায় 3.6 মিলিয়ন মানুষের ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে যা হল প্রতি 100 জনের মধ্যে প্রায় 6 জন। যাদের রোগ এখনও ধরা পড়েনি এবং যারা জানেন না যে, তাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এই সংখ্যাটি 4 মিলিয়নের বেশি হয়ে যাবে।
সূত্রঃ knowdiabetes
ডায়াবেটিসের ধরন
টাইপ-১
শিশু ও তরুণদের মধ্যে এ ধরনের বহুমূত্র হয় বেশি। ১০-৩০ বছরের মধ্যে দেখা দেয়। টাইপ-১ এর রোগীদের অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। একারনেই এদের দেহে খুবই কম ইনসুলিন উৎপাদিত হয় । এ জন্য রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্প নিতে হয়। ইহা মূলত জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে।
টাইপ-১-এ
অটোইমিউনিটির (autoimmune) জন্য বিটা কোষ ধ্বংসের কারণে এই টাইপ-১-এ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে ।
টাইপ-১-বি
টাইপ-১-বি এটিও বিটা কোষের ধ্বংসের কারণে হয়ে থাকে, কিন্তু এর সঠিক কারণ জানা যায়নি।
টাইপ-২
৪০ বছর বা তারপরে টাইপ-২ বহুমূত্র রোগ দেখা দেয়। এ ধরনের রোগীরা শরীরে যে ইনসুলিন উৎপন্ন করে, তাকে ব্যবহার করতে পারে না। ব্যায়াম ও খাদ্যবিধির সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবিলা করা হয়। তবে অনেক সময় প্রয়োজন হয় মুখে খাওয়ার ওষুধ, এমনকি ইনসুলিন ইনজেকশন। মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় পানীয় টাইপ-২ এর ঝুঁকি বাড়ায়। অত্যধিক পরিমাণ সাদা ভাত খাওয়ার কারনেও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। শারীরিক পরিশ্রম না করাও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম একটা কারণ। বিশ্বজুড়ে ২৪৬ মিলিয়ন ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি হল টাইপ-২ ডায়াবেটিস। দুই ধরনের ডায়াবেটিসই গুরুতর এবং হতে পারে শিশু ও তরুণদেরও।
সূত্রঃ উইকিপিডিয়া
গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা যায়। প্লাসেন্টাল হরমোনের কারণে ইনসুলিনের মাত্রা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে শরীর তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না । ~ সূত্রঃ bumrungrad
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের (WHO) মতে ২০৩০ সালে ডায়াবেটিস পৃথিবীতে মৃত্যুর সপ্তম কারন হয়ে দাড়াবে।
ডায়াবেটিসের লক্ষন
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ডায়াবেটিসের কিছু সাধারন লক্ষন, যেসব লক্ষন দেখলে অতি দ্রুত সতর্ক হতে হবে
- ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া, যার ফলে প্রস্রাব ধারনে ও পিপাসা লাগা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া
- দুর্বল লাগা, ঘোর ঘোর ভাব আসা, তন্দ্রাচ্ছন্নতা ভাব, প্রচন্ত ক্লান্তি অনুভব
- ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া (নিয়মিত খাদ্যগ্রহনের পরও খুদা)
- মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া
- কোন কারণ ছাড়াই অনেক ওজন কমে যাওয়া
- শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটাছেঁড়া, ঘা বা ক্ষত সহজে সারে না
- বিরক্তি ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠা
- চোখে কম দেখতে শুরু করা
রোগী যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তবে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জন্য তার কিডনি, লিভার, রক্তনালি, স্নায়ু, চোখ ও হৃদযন্ত্রের সমস্যাসহ নানা রকম ও ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডায়াবেটিসের সমস্যা
দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস অশনাক্ত থাকলে বা চিকিৎসা না হলে কিডনি, লিভার, রক্তনালি, স্নায়ু, চোখ ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা, শরীরের ত্বক নষ্ট হয়ে যায়, চুল পড়ে যাওয়াসহ বিনা দুর্ঘটনায় অঙ্গচ্ছেদসহ শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
Image From: hesperian.org
আরো পড়ুনঃ হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতে ডায়াবেটিস রোগ ও ক্ষতের চিকিৎসা
কিডনি ভালো রাখার উপায় ও খাদ্যসমূহ
বিবিসির জরিপ
ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সংখ্যা ১৯৮০ সালে ১১৮ মিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৪ সালে ৪২২ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে
ডায়াবেটিসের প্রতিকার
- হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহন করুন
- ইনসুলিন
- অ্যান্টিডায়াবেটিক ঔষধ ( মুখে খাওয়ার ঔষধ )
- জীবনধারার পরিবর্তন:
- নিয়মিত ব্যায়াম
- প্রতিদিন এক ঘণ্টা হাঁটুন
- বেশি শারীরিক পরিশ্রম করুন
- খাদ্য গ্রহণে অধিক সচেতনতা
- মিষ্টি পরিহার করুন
- রিফাইন করা চিনি পরিহার করুন
- ধূমপান পরিহার করুন
- ডায়াবেটিস সম্বন্ধে রোগীরা প্রয়োজনীয় ধারণা গ্রহন করুন।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে রাখুন
ইনসুলিন আবিষ্কার
ইনসুলিন আবিষ্কার এবং ডায়াবেটিসে এর ভূমিকা ছিল একটি যুগান্তকারী চিকিৎসার সেই মাত্রা যা কয়েকজন বৈজ্ঞানিক দলকে নোবেল প্রাইজের সম্মানে সম্মানিত করেছিল।
১৮৮৯ সালে, দুই জার্মান গবেষক বিজ্ঞানি অস্কার মিনকোভস্কি এবং জোসেফ ভন মেরিং তাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন যেসব কুকুরদের অগ্ন্যাশয় সরিয়ে ফেলা হয়েছিলো তাদের ডায়াবেটিস হয়েছে এবং শীঘ্রই মারা যায়।
১৯১০ সালে, স্যার এডওয়ার্ড আলবার্ট শার্পে-শেফার পরামর্শ দেন যে ডায়াবেটিস রোগীদের অগ্ন্যাশয়ে শুধুমাত্র একটি রাসায়নিক অনুপস্থিত ছিল এবং তিনি এই রাসায়নিককে ইনসুলিন নামকরনের করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯২১ সালে, ফ্রেডরিক ব্যান্টিং নামে একজন তরুণ সার্জন এবং তার সহকারী চার্লস বেস্ট আবিষ্কার করেছিলেন কীভাবে কুকুরের অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন অপসারণ করা যায়।
ফ্রেডরিক গ্র্যান্ট বেন্টিং এবং চার্লস এইচ বেস্ট গুরুতর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত একটি কুকুরকে ৭0 দিনের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলেন - কুকুরটি তখনই মারা গিয়েছিল যখন অগ্ন্যাশযয়ে আর কোনও ইনসুলিন ছিল না। এই সাফল্যের সাথে গবেষকরা, সহকর্মী জেমস কলিপ এবং জন ম্যাকলেয়ড এর সাহায্যে, আরও এক ধাপ এগিয়ে যান।
অবশেষে জেমস কলিপ এবং জন ম্যাক্লিওড গবাদি পশুর অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন সংগ্রহ করে তা পরিশোধন পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ করেন এবং মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার মাধ্যমে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসেন ।
ইনসুলিন আবিষ্কারে সাফল্য
১৯২২ সালের জানুয়ারিতে বিজ্ঞানীদের চেষ্টার ও আগ্রহের মূলকেন্দ্র ছিলো টরন্টোর একটি হাসপাতালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ১৪ বছর বয়সী লিওনার্ড থম্পসন, যার জীবনে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। লিওনার্ড ডায়াবেটিসের কঠিনতম অবস্থায় ছিল এবং তার অবস্থাও ছিলো গুরুতর। পরিশোধিত ইনসুলিন প্রথম ডোজ পাওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্য তার রক্তে শর্করার মাত্রা আকাশ চুম্বি ৫২০মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এরপর তা মাত্র ১২০মিলিগ্রাম/ডেসিলিটারে নেমে যায় এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা প্রায়-স্বাভাবিক স্তরে নেমে আসে।
চাক্ষুস তার অবস্থার উন্নতি হয়েছিলো,তিনি ইনসুলিন গ্রহন চালিয়ে গিয়েছেন এবং বেঁচে ছিলেন । ইনসুলিনের জন্য লিওনার্ড থম্পসনের মৃত্যু-দ্বার থেকে বেঁচে আসাটা বিশ্বজুড়ে সমস্ত ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আশার আলো হয়ে উঠে ।
ইনসুলিনের এই সফলতার খবর সারা বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৩ সালে, ফ্রেডরিক গ্র্যান্ট বেন্টিং এবং ম্যাক্লিওড মেডিসিনে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন, যা তারা চার্লস বেস্ট এবং জেমস কোলিপের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন। ধন্যবাদ, ডায়াবেটিস গবেষকদের!
১৯৮২ সাল থেকে ইনসুলিনের উৎপাদনের জন্য আর প্রাণীর উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় নি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অগ্রগতির ফলে ব্যাক্টেরিয়া থেকে মানব ইনসুলিন উৎপাদন সম্ভব হয়েছে ।
১৯৮৫ সালে ইনসুলিন পেন আবিষ্কার করা হয়েছিলো, কার্যকারিতার অপরিহার্য উন্নতি, সুবিধাসমূহ, এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জীবনের চূড়ান্ত নিশ্চয়তা।
১৯৯৭ সালের দিকে ইনসুলিনের পুরাতন আবিষ্কার গুলো মানব দেহের উপযোগী অনুয়ায়ী পরিবর্তিত হয়ে আসে । এটি ডায়াবেটিস রোগীদের এবং তাদের পরিবারের জন্য তাদের নিজস্ব দৈনিক সময়সূচী এবং ক্রিয়াকলাপ অনুসারে ইনসুলিন গ্রহণের উপযোগী করে তাদের জীবনমানকে আরও উন্নত করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ইনসুলিন ১০০ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমান অবস্থায় আসেছে ।
ইনসুলিন ইতিহাসের তথ্যসূত্রঃ bumrungrad
২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এর ৬১/২২৫ নম্বর ঘোষণায় ডায়াবেটিসকে দীর্ঘমেয়াদি, অবক্ষয়ী ও ব্যয়বহুল ব্যাধি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা মানবদেহে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া
তথ্যসূত্র
https://bn.wikipedia.org/
diabetes.org - The History of a Wonderful Thing We Call Insulin
https://www.prothomalo.com
https://www.knowdiabetes.org.uk/
https://www.bbc.com/
https://www.bbc.com/
https://www.bumrungrad.com
https://bn.hesperian.org/